আদর্শ শিক্ষার্থী
প্রতনু রক্ষিত
***
আজ পাঁচু ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস। সকাল থেকেই বিদ্যালয়ে একটা হৈ হৈ ব্যাপার। শহরের নাম করা স্কুল। অধিকাংশ ছাএই ধনী পরিবারের। নিজেরা সব মোটা টাকা চাঁদা তুলেছে। মঞ্চের সাজ সজ্জাতে তার ছাপ সুস্পষ্ট। সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকাদের জন্য দামী দামী গিফ্ট, দারুন লাঞ্চ প্যাকেট। সব মিলিয়ে এলাহী ব্যাপার।
প্রায় সব ছাত্রদের দেখতে পেলেও প্রকাশদের ব্যাচটা চোখে পড়লো না। ছেলেদের কাছে খবরাখবর নিয়ে জানলাম প্রকাশরা নাকি পাঁচশো টাকা করে চাঁদা দিতে পারে নি, সেই লজ্জায় তারা আজ স্কুলে আসে নি।
প্রকাশ মুদি, অতনু কুর্মি, দেবা মাহাতো আর রাজ কিস্কু এই চার জন দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র, এই স্কুলের ব্যতিক্রম। আসলে এরা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা চার জন ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও মেধাবী ছাত্র তাই অনেক বাধা সত্ত্বেও হেডস্যার নিজের জোরে ওদের এই স্কুলে রেখেছেন।
আজকের দিনে ওদের না দেখতে পেয়ে সত্যি ই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আসলে আজকালকার দিনে এই রকম ওবিডিয়েন্ট স্টুডেন্ট দেখতে পাওয়া মুশকিল।
স্টেজে বসে এসব ভাবছি হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। রিসিভ করতেই আঁতকে উঠলাম। মেয়ের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। নার্সিং হোমে ভর্তি। প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন সিনিয়র স্টুডেন্টকে আমার সাথে যাওয়ার জন্য বললাম। ওরা বললো- আপনি চলুন স্যার আমরা এদিকটা একটু সামলে নিয়ে যাচ্ছি।
নার্সিং হোম জানালো ইমিডিয়েট তিন ইউনিট ব্লাড লাগবে, না হলে পেসেন্টকে বাঁচানো মুশকিল হবে। আমার তো মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এত তাড়াতাড়ি কোথায় রক্ত পাবো?? সহকর্মী থেকে শুরু করে ছাএদের অনেক ফোন করলাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না।
চিন্তায় নার্সিং হোমের চেয়ারে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি। এমন সময় পরিচিত গলার আওয়াজ পেলাম। -- স্যার কী হয়েছে? -- মাথা তুলে দেখি প্রকাশ, অতনু, দেবা, রাজ আরো জনা পাঁচেক ছেলে। আমি প্রায় কেঁদে ফেলেই বললাম-- তিন বোতল রক্ত লাগবে এক্ষুনি। কথা শেষ হতে না হতেই অতনু বলল- আপনি কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। আমরা আছি। শুধু কী গ্রুপ বলুন। আমি বললাম-- এবি পজেটিভ। রাজ সঙ্গে সঙ্গে বলল- আমার এবি পজেটিভ। আর আমাদের পাড়ার সোমদা আর বিজয়ের ও তাই। প্রকাশ বলল- রাজ, তুই এখানেই ব্লাডটা দে। আমি সোম দা আর বিজয়কে এখানে নিয়ে আসছি। আর দেবা তুই স্যারের কাছে থাক।
রাত এগারোটার সময় ডাক্তার জানালেন পেসেন্টের অবস্থা স্থিতিশীল। আমি এবার প্রকাশকে বললাম- তোরা এবার বাড়ি যা বাবা। অনেকক্ষণ থেকে বসে আছিস।
–কি বলছেন স্যার। আপনাকে এখানে একা ফেলে আমরা কেউ যাব না। আপনি তো আমাদের সেরকম শিক্ষা দেন নি। বিপদে সর্বদা মানুষের পাশে থাকার শিক্ষাই দিয়েছেন। সে শিক্ষা কী করে ভুলি স্যার।
শিক্ষক দিবসে আমার ছাত্রদের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ হিসেবে মনে করে আমি আদর্শ শিক্ষার্থীদের মাঝে গিয়ে বসে পড়লাম।